* জড়িত রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট * মৃত মানুষের লাশ ও কঙ্কাল চুরি হচ্ছে * লাশ বিক্রি হয় ১ থেকে ৩ লাখ টাকায় * একজোড়া কঙ্কাল ৪০-৫০ হাজার টাকা
লাশ চুরির ব্যবসা জমজমাট
তুরাগ থেকে মনির হোসেন জীবন
রাজধানীসহ দেশজুড়ে রাতের অন্ধকারে কবর থেকে মৃত মানুষের মরদেহ ও কঙ্কাল চুরির হিড়িক পড়েছে। ইদানিংকালে লাশ চুরির এই জমজমাট ব্যবসা অনেকটাই তুঙ্গে রয়েছে! এই ব্যবসার সাথে শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট জড়িয়ে পড়েছে। মৃত মানুষের মরদেহ চুরি করতে কিংবা ব্যবসার প্রসার ঘটাতে ইতোমধ্যে ঢাকা নগরীসহ আট বিভাগীয় শহরগুলোতে শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে।
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় রাত কিংবা ভোরে পারিবারিক কিংবা গনকবরস্থান থেকে অহরহ লাশ চুরি কিংবা গায়েব হয়ে যাচ্ছে এমন অভিযোগ উঠেছে। দেশের সকল সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল গুলোতে ও মাঝেমধ্যে লাশ চুরির ঘটনা ঘটেই চলেছে। এসব কবর থেকে নিত্যনতুন কিংবা অভিনব কৌশলে লাশ চুরির জমজমাট এই ব্যবসা বন্ধ হবে কবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, মরা মানুষের লাশ কিংবা কঙ্কাল চুরির এই নেক্কারজনক ব্যবসা বন্ধ করা উচিৎ। এব্যাপারে সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে এবং সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে, এমনটিই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ও সচেতন ব্যক্তিরা। সূত্র বলছে, লাশ চুরি করে সেই মরদেহ সেদ্ধ করে মাংস ছাড়িয়ে কঙ্কাল বের করে সেই কঙ্কাল দেশের মেডিকেল কলেজ গুলোতে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে কৌশলে বিক্রি করা হচ্ছে। এমনটাই অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল, চট্টগ্রাম, রংপুর, সিলেট, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল গুলোতে অনেক সময় মরা মানুষের লাশ উধাও হয়ে যায়। অনেক সময় অজ্ঞান মানুষের মরদেহ হাসপাতালের ভেতরে ও বাহিরে ফেলে রেখে একটি সংঘবদ্ধ চক্র কৌশলে ছিটকে পড়ে। তখন ওই লাশের পরিচয় অনেক জায়গায় অনুসন্ধান কিংবা খোঁজ খবর নিয়ে পাওয়া না গেলে তখন ওই লাশটি বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে গন্য করা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিভিন্ন তথ্য সূত্রে জানা যায়, ২০২৫ সালের ২০ এপ্রিল দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা থানার সীডস্টোর ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের সোনার বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে একটি যাত্রীবাহী বাসে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা গোপনে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ মৃত মানুষের কঙ্কালসহ মো. সাইফুল (৪৫), ফারুক হোসেন (৪৮) এবং আলমগীর হোসেন (২৪) নামে তিনজনকে আটক করেছে। ওই সময় আটক ব্যক্তিদের নিকট থেকে একটি ট্রাভেল ব্যাগে মৃত মানুষের তিনটি মাথার খুলি, শরীরের বিভিন্ন অংশের ২৮টি হাড়, একটি মেরুদণ্ডের হাড় পাওয়া যায়। পরে এগুলো জব্দ করে পুলিশ। সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ বলছে, আটককৃত ব্যক্তিরা শেরপুর ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন কবর থেকে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মৃত মানুষের হাড় চুরি করে ব্যবসা করে আসছিল। এ ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে।
অপরদিকে, ২৬ মে ২০২৫ দুপুরে ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল থানার বাচোর ইউনিয়নের মীরডাঙ্গী বাজার এলাকার টেকিয়া মহেশপুর কবরস্থান থেকে একই পরিবারের ৪টি কঙ্কাল সংঘবদ্ধ চোর চক্রের সদস্যরা চুরি করে নিয়ে যায়। এবিষয়ে স্থানীয় এলাকাবাসী ও সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ বলছে, মীরডাঙ্গী বাজার এলাকার বাসিন্দা আমিরুল ইসলাম, রাবেয়া বেগম, জরিফা বেগমসহ চার আত্মীয়কে টেকিয়া মহেশপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। কেউ মারা গেছেন দু’বছর আগে আবার কেউ দেড় বছর আগে। সবশেষ দাফন করা হয় আমিরুল ইসলামকে সাড়ে ৪ মাস আগে। তাদের কারো মরদেহ কবরের ভেতর নেই । নিহতের স্বজন ও এলাকাবাসীদের অভিযোগ, কবর থেকে যে কঙ্কাল চুরি হয়েছে, তা স্পষ্ট বোঝা যায়। তার কারণ, প্রতিটি কবরের ওপরে দেওয়া বাঁশগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে এদিক সেদিক পড়ে আছে। কবর থেকে কঙ্কাল বের করেছে তার চিহ্ন রয়েই গেছে। এদিকে রাণীশংকৈল থানা পুলিশ মরদেহ চুরির বিষয়টি স্বীকার করেছেন। এছাড়া চলতি বছরের জুন ২ সকালে পঞ্চগড় পৌর এলাকার কাগজিয়াপাড়া কবরস্থান পাঁচটি কঙ্কাল চুরির ঘটনা ঘটে। পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, ঘটনার দিন সকালে স্থানীয় তেলিপাড়া গ্রামের এক ব্যক্তি কবর জিয়ারত করতে গেলে পুরাতন খোঁড়া কবর ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মাটি দেখতে পান। বিষয়টি জানাজানি হলে মৃত ব্যক্তিদের স্বজনরা ছুটে আসেন। কঙ্কাল চুরি যাওয়া কবরের মৃত ব্যক্তিরা হলেন- ২০২৪ সালে মারা যাওয়া তসিরুল আলম (৭৫), চার বছর আগে মারা যাওয়া রাইয়ান আজমি বিজয় (১৫), দুই বছর আগে মারা যাওয়া হামিদা বেগম (৭০) ও এক বছর আগে মারা যাওয়া আব্দুস সাত্তার (৭০)। পঞ্চগড় সদর থানার পুলিশ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এছাড়া ইতোপূর্বে জামালপুর সদর উপজেলার ঘোড়াধাপ ইউনিয়নের ইদিলপুর গ্রামের একটি কবরস্থান থেকে গত এক মাসে রাতের আধারে কবর খুড়ে কঙ্কাল চুরি হয়েছে কমপক্ষে ১০-১২টি। গত দুই বছরে এমন চুরির সংখ্যা শতাধিক বলে জানিছেন স্থানীয়রা। কঙ্কাল চুরির এমন ঘটনায় আতঙ্কিত ও অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে গ্রামবাসী।
সম্প্রতি একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি গাজীপুরের একটি কবরস্থান থেকে ২৩টি মরদেহ চুরি হয়ে যায় । এর আগে শেরপুরের একটি কবর স্থান থেকে ৫টি লাশ চুরি হয়। এছাড়া রাজধানীর উত্তরা, তুরাগ, উত্তরখান, দক্ষিণখান, যাত্রাবারি, শনির আখড়া, মিরপুর, কালশী, মোহাম্মদপুর, কামরাঙ্গীচর, লালবাগ, হাজারীবাগ, রূপনগরসহ নগরীর বিভিন্ন কবরস্থান থেকেও লাশ চুরির কথা শোনা গেছে। ইতোমধ্যে রাজধানী ও ঢাকার বাহিরে লাশ চুরি সিন্ডিকেটের একাধিক সদস্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার এমন চাঞ্চল্যকর ও অনেক ভয়ংকর তথ্য প্রকাশ পেয়েছে।
ভুক্তভোগী, স্বজনহারা পরিবার এবং এলাকাবাসী অভিযোগ, চোর সিন্ডিকেটের সদস্যরা কবর থেকে মধ্য রাত কিংবা ভোরের দিকে লাশ চুরি করে অন্যত্র নিয়ে যায় তারা আসলে কারা! কি তাদের আসল পরিচয়। কে দেয় তাদের আশ্রয়-পশ্রয় ও শেল্টারদাতা। ভদ্র বেশি রাঘববোয়ালরা থাকে ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। ভুক্তভোগী পরিবার গুলোর অভিযোগ - এটার কোনো বিচার কোনো খানে পাচ্ছি না। আমরা কাকে বলবো? এসব বন্ধে দেশে কি কেউ নেই। এব্যাপারে বর্তমান সরকার প্রধান, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উচিৎ-রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশজুড়ে সাঁড়াশি অভিযানের মাধ্যমে অনতিবিলম্বে অপরাধীদের খোঁজে বের করে তাদেরকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন নগরবাসী ও ভুক্তভোগী পরিবারগুলো।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ